তথ্যপ্রযুক্তি ও বাংলাদেশ

প্রবন্ধ রচনাসমূহ

  • ৭ মাস আগে
  • |
  • ২০২ জন দেখেছেন

সূচনা

বর্তমান যুগ তথ্য প্রযুক্তির যুগ। এ যুগে বিশ্বের প্রতিটি দেশই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তথ্যপ্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। বিশ্বের প্রতিটি দেশ আজ তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে জীবনকে সহজ ও সুবিধাজনক করে তাদের সকল কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এরই ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির উদ্ভব হতে শুরু করেছে। যদিও বাংলাদেশে প্রক্রিয়াটি দেরিতে শুরু হয়েছে, তবুও আমাদের দেশের উন্নয়নের কথা ভাবতে হবে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সব ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি প্রয়োগ করতে হবে।

অতীত পটভূমি

বাংলাদেশ ক্যাবল অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন বোর্ড প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ক্ষেত্রে সেবা দিয়ে আসছে। যোগাযোগ স্যাটেলাইট প্রযুক্তি প্রবর্তনের আগে, এইচএফ প্রযুক্তি ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক টেলিফোন পরিষেবা সরবরাহ করা হয়েছিল, যার ক্ষমতা খুব সীমিত ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন রাঙ্গামাটি জেলার কাউখালী উপজেলার বেতবুনিয়ায় দেশের প্রথম ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র চালু করেন। এরপর তালেবানবাদ, মহাখালী ও সিলেটে পর্যায়ক্রমে আরো ৩টি স্যাটেলাইট কেন্দ্র চালু করা হয়। দেশে বেসরকারি খাতে ইন্টারনেট ও আইসিটি সংক্রান্ত কার্যক্রম বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশে ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের পাশাপাশি ৯০-এর দশকে ভি-স্যাটের ব্যবহার শুরু হয় এবং পরবর্তীতে ভি-স্যাটের ব্যবহার চালু হয়। এরই মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের টেলিযোগাযোগ নীতি, আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বাংলাদেশকে গ্লোবাল ইনফরমেশন সুপার হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত করার আইসিটি টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা শীর্ষক একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং পশ্চিম ইউরোপের 14টি দেশের মোট 16টি কোম্পানির সমন্বয়ে একটি কনসোর্টিয়ামে (SEA-ME-WE-4) যোগদানের জন্য বাংলাদেশ 2002 সালে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে।

তথ্যপ্রযুক্তির ধরন ও বৈশিষ্ট্য

তথ্য প্রযুক্তির বড় বৈশিষ্ট্য হল এটি যথেষ্ট শক্তিশালী একটি প্রযুক্তি যা সাধারণ মানুষ ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষ সহজেই দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। মুহূর্তের মধ্যে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে শব্দ, ছবি এবং পাঠ্য বিনিময় করা সম্ভব হচ্ছে। এটি এমন একটি প্রযুক্তি যা বিশ্বের যেকোনো দেশের মানুষ আয়ত্ত করতে পারে এবং অবদান রাখতে পারে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। এর দ্বারা সৃষ্ট নতুন চাকরির বেশিরভাগই বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলির জন্য উপযোগী। এই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে কাউকে শহরে ছুটতে হবে না; বরং যেখানেই থাকুক না কেন নতুন ধরনের আয়-উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে কোনো বাধা নেই।

রপ্তানি বাণিজ্যে সম্ভাবনা সৃষ্টি 

রপ্তানি বাণিজ্যের ক্রমাগত সম্প্রসারণে তথ্যপ্রযুক্তি অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দিকে তাকালে এর সত্যতা সহজেই প্রমাণিত হয়। প্রতিবেশী দেশ ভারত এ কাজে অনেক দূর এগিয়েছে। বর্তমানে, ভারতের মোট রপ্তানি বাণিজ্যের একটি বড় অংশ আসে সফটওয়্যার শিল্প থেকে। এ শিল্প শিগগিরই পোশাক শিল্প থেকে অর্জিত আয়কে ছাড়িয়ে যাবে এটা নিশ্চিত।
 

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক

তথ্য প্রযুক্তি সফটওয়্যার রপ্তানির পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের আরও অনেক পথ খুলে দেবে। আইটি-এর প্রধান চালক হল স্বল্প বেতনের দক্ষ কর্মীবাহিনী। এই ব্যবস্থায় যত কম বেতনে প্রশিক্ষিত জনশক্তি তৈরি করা যাবে, বিদেশ থেকে তত বেশি চাকরি আনা হবে।
জনবল তৈরি করা কোনো সমস্যা নয়। চাহিদা দেখা দিলে সুযোগ গ্রহণের উপযোগীতা তৈরি করতে দেরি হবে না। বিশ্বব্যাপী উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যে পরিমাণ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসা করা যায়, তার ৫০ শতাংশ করা সম্ভব হলে আমাদের দেশের মানুষের কর্মসংস্থানের কোনো অভাব হবে না।

তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারে করণীয়

তথ্য প্রযুক্তির প্রসারের জন্য টেলিফোন ও ইন্টারনেট অবকাঠামো শক্তিশালী করতে হবে। সবার জন্য তথ্যপ্রযুক্তি নিশ্চিত করতে হলে টেলিফোন সেবা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে হবে। এই ক্ষেত্রে, বিটিটিবিকে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা যেতে পারে এবং স্থায়ী টেলিফোন খাতকে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করা যেতে পারে। দেশের অর্থনীতিতে গতিশীলতা আনতে টেলিফোন হতে পারে সবচেয়ে কার্যকরী মাধ্যম। বেসরকারি উদ্যোক্তারা এ ব্যাপারে এগিয়ে এলে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ প্রতিষ্ঠার জন্য অবিলম্বে আমাদের দেশে টেলিফোনের আন্তর্জাতিক গেটওয়ে খুলে দিতে হবে, যাতে দেশের যেকোনো ব্যবসায়ী বৈধভাবে এ ব্যবসা পরিচালনা করতে পারে। এসব পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়িত হলে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসা যথেষ্ট গতি পাবে এবং দেশের জন্য ব্যাপক সুফল বয়ে আনবে।

গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেটের প্রসার

টেলিফোন ও ইন্টারনেট যত সস্তা হবে, ততই সাধারণ মানুষ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে জনগণ তাদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের নিজস্ব সমস্যা সমাধানের সুযোগ পাবে। তাই তথ্যপ্রযুক্তি মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত। তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো স্থাপন ও পরিচালনা থেকে কর সংগ্রহ করে রাজস্ব বাড়ানোই সরকারের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। তথ্য প্রযুক্তির দ্রুত সম্প্রসারণকে উৎসাহিত করা এবং বৃহত্তর প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করা সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের উন্নয়ন

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ছাড়াও তথ্য প্রযুক্তি দেশের অভ্যন্তরে মানুষের জন্য অনেক সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। সকলের পক্ষেই অবিলম্বে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা সম্ভব কারণ এই প্রযুক্তি ব্যবহার করার জন্য কারও স্কুল-কলেজ পাস করার প্রয়োজন নেই। একজন অশিক্ষিত ব্যক্তি যে তার জীবনে কখনো তথ্য প্রযুক্তির কথা শোনেনি সে নির্ভয়ে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে। তথ্য প্রযুক্তি স্বাস্থ্যসেবা, জ্ঞান ও বিজ্ঞানকে সবার জন্য সহজলভ্য করে তুলতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন উদ্যোগ ও আন্তরিকতা।

সাবমেরিন ক্যাবলের অভাব, টেলিফোনের অপ্রতুলতা, ইন্টারনেটের সীমাবদ্ধতা এবং ব্যান্ডউইথের অপ্রতুলতা মানব জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের সেবা নিশ্চিত করতে পারে। বর্তমান সরকার রেলওয়ে ফাইবার অপটিক ব্যবহারের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে এবং সকল মানুষের ব্যবহারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ খুলে দিয়েছে। এটি আইটির জন্য একটি দুর্দান্ত সুযোগ। এর ফলে প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রীরা নিজ দফতরে বসে দেশের যেকোনো স্থানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মুখোমুখি বৈঠক করতে পারবেন। ঢাকা শহরের চিকিৎসকরা অন্য শহরে অবস্থানরত রোগীদের চিকিৎসা করতে পারেন। ঢাকার ব্যবসায়ীরা তাদের নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসে সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য ব্যবসায়ীর সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলে ব্যবসা সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে পারেন অথবা ইন্টারনেটের মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন।

উপসংহার

তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হলে এখানে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। দেশের প্রতিটি জেলা ও থানা পর্যায়ে তথ্য প্রযুক্তি প্রয়োগ করতে হবে। তবেই তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে জনগণ তাদের জীবনমান উন্নত করতে পারে এবং দেশের উন্নয়নের সূচনা করতে পারে। তাই এ বিষয়ে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার নজর রাখা জরুরি।

আরও দেখুন

পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার
পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার
প্রবন্ধ রচনাসমূহ
পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার
পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার
প্রবন্ধ রচনাসমূহ
শিষ্টাচার
শিষ্টাচার
প্রবন্ধ রচনাসমূহ