শিষ্টাচার

প্রবন্ধ রচনাসমূহ

  • ২ মাস আগে
  • |
  • ১০৩ জন দেখেছেন

সূচনা

শিষ্টাচার বলতে আমরা এক কথায় পরিশীলিত আচরণকে বুঝি। শিষ্টাচার একটি সুন্দর মনের মধুর আচরণগত বহিঃপ্রকাশ। তার চরিত্র মানুষের মধ্যে লালিত সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ। ভদ্রতা হল সৌন্দর্যের প্রতীক। ভদ্রতা মানুষের চরিত্রকে আকর্ষণীয় করে তোলে। একজন মানুষ যত বেশি ভদ্র, সে অন্যদের কাছে তত বেশি গ্রহণযোগ্য। উত্তম আচরণ মানুষের মনকে উদার করে।

শিষ্টাচারের পরিচয়

আচার-আচরণ ও কথাবার্তায় শালীনতা, শালীনতা ও সৌজন্যতাকে শিষ্টাচার বলে। অন্য কথায়, মানুষের দৈনন্দিন আচরণ, কথাবার্তা এবং এর বাহ্যিক দিককে ভদ্রতা বলে। লোকেরা ভদ্র হতে পারে না যদি তারা তাদের আচরণে মার্জিত না হয়, যদি তারা তাদের ব্যবহারে কঠোরতা এড়ায় না। প্রকৃতিতে অহংকার ও কঠোরতা এড়াতে না পারলে মন মধুর হয় না।
মানুষ যত বেশি চরিত্রের মাধুর্য অর্জন করে, সে তত বেশি গুণী হয়। ভদ্রতা একজন ব্যক্তির আচরণকে মার্জিত, কথাবার্তাকে সৎ ও সঠিক করে তোলে। আচরণহীন মানুষ সবসময় অহংকারী হয়। তার আচরণে অবজ্ঞা, অহংকার, গালিগালাজ এবং অভদ্রতার প্রাধান্য রয়েছে। অহংকার অন্যকে ছোট করতে উৎসাহিত করে কিন্তু শালীনতা মানুষকে সম্মান করতে উৎসাহিত করে। ভালো ব্যবহারই বলে দেয় একজন মানুষ কেমন। বিনয়ের পরিচয় কেবল তার বাহ্যিক দিকই নয়, ভিতরের চিন্তার প্রতিফলনেও বিনয়ের পরিচয়। কারণ মানুষ স্বভাবতই ভেতর থেকে তার চিন্তা প্রকাশ করতে উদ্বুদ্ধ হয়।

 

শিষ্টাচারের গুরুত্ব

সমাজকে সুন্দর ও উন্নত করতে সদাচার চর্চার বিকল্প নেই। মানুষ সামাজিক জীব তাই তাদের সমাজের অন্যান্য মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে হয়। তার আচরণে শালীনতা না থাকলে সে পশুর মতো হয়ে যায় এবং তখন সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। অন্যদিকে ভদ্র আচরণ সমাজকে সুন্দর করে। ভদ্র আচরণের মাধ্যমে মানুষের মন ও বিশ্বাস অর্জন করা যায়, এতে মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি বাড়ে।

শিষ্টাচার একজন ব্যক্তির প্রকৃতির উপর আলোকপাত করে। সেই আলো ব্যক্তি ও পরিবার থেকে সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে। এই আলোয় উদ্ভাসিত ব্যক্তির আধ্যাত্মিক মুক্তিতে মানবিক সম্প্রীতি ও সম্প্রীতি যুক্ত হয়। তার সৌজন্য ও বিনয় দ্বারা, সিস্তাজান সকলের ভালবাসা অর্জন করে, অন্যের বিশ্বাস অর্জন করে। অন্যের সহানুভূতি, ভালবাসা এবং সম্মান পাওয়ার জন্য একজন গুণী ব্যক্তি সর্বোত্তম। তাই সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে সদাচারের কোনো বিকল্প নেই। এটি একটি আদর্শ সমাজ গঠনে সবার আন্তরিকতার পরিচয় দেয়। চূড়ান্ত পর্যায়ে সমাজ শান্তি ও সম্প্রীতির শয্যায় পরিণত হয়।

ছাত্রজীবনে শিষ্টাচার

ছাত্রজীবনে অধ্যবসায়, নিষ্ঠা, উদ্ভাবন ও শৃঙ্খলার পাশাপাশি শিষ্টাচারের চর্চা খুবই জরুরি। সৌজন্য ও শিষ্টাচারের স্পর্শে একজন ছাত্র নম্র ও বিনয়ী হয়ে ওঠে। কোনো শিক্ষার্থীর প্রতি অশালীন অভদ্র ও অভদ্র আচরণ কখনোই কাম্য নয়। শিষ্টাচার এবং সৌজন্য ছাত্র জীবন মানবতা অর্জন সম্পর্কে। সৌজন্য ও আচার-আচরণের অভাব থাকলে ছাত্রজীবন থেকে ভালোবাসা, সহানুভূতি, সহানুভূতি, বিনয় ইত্যাদি হারিয়ে যায়। সে অহংকারী, স্বার্থপর এবং নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। তাই শিক্ষার্থীদের নৈতিক চরিত্র অর্জন করতে হবে। আর এর প্রধান দায়িত্ব পিতা-মাতা, শিক্ষক ও সমাজের। তাই নৈতিক চরিত্রের বিকাশের জন্য ছাত্রজীবনে শালীনতাবোধের কোনো বিকল্প নেই।

শিষ্টাচার এবং সামাজিক জীবন

প্রতিটি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শিষ্টাচারের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তা না হলে সমাজে বিশৃঙ্খলা, হানাহানি, অন্যায়, মারামারি, নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতা দেখা দেয়। শিষ্টাচারের অভাব থাকলে সমাজ প্রেমহীন হয়ে পড়ে। গোটা সমাজ বিদ্বেষ ও সহিংসতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। তাই সমাজে ব্যাপক বিপর্যয়। শিষ্টাচারের অভাবে সমাজে সৌন্দর্য ও সুকুমা প্রবৃত্তি হারিয়ে যাচ্ছে। ভালোবাসা ও সহানুভূতির অভাবে মানুষ বিচ্ছিন্ন, স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে।
এবং একমাত্র ভাল আচরণ যা এই অমানবিক, শূন্য মনহীন সমাজকে বিবেকের বোধ জাগ্রত করতে পারে তা হল শালীনতা।

শিষ্টাচার এবং রাষ্ট্র

শিষ্টাচার শুধু সামাজিক জীবনেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। রাষ্ট্রীয় জীবনে শিষ্টাচার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র পরিচালনায় জাতীয় জীবনে শিষ্টাচার প্রকাশ পায়। নেতা, কূটনীতিক এবং দেশ পরিচালনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের মধ্যে ভালো আচরণের কোনো বিকল্প নেই। রাষ্ট্রের জীবনে শিষ্টাচারের প্রভাব পরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

শিষ্টাচার ও ধর্মীয় জীবন

শিষ্টাচার শেখার প্রধান মাধ্যম হল ধর্মীয় শিক্ষা। শুধুমাত্র ধর্মীয় শিক্ষাই পারে একজন মানুষকে উত্তম চরিত্রের অধিকারী করতে। প্রতিটি ধর্মই শিষ্টাচার শেখার উপর জোর দেয় বিশেষ করে মুসলিম ধর্মে এটি মানুষের সাথে সৎ আচরণ করার বিষয়ে। যার অন্তর শুদ্ধ এবং অপবিত্র - তিনি ভদ্র আচরণের অধিকারী, তিনি একটি চির-স্মিত মুখের অধিকারী। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ছিলেন শিষ্টাচারের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। মহানবী (সা.) তাঁর সততা ও ভালো আচরণের জন্য সকলের কাছে প্রিয় ছিলেন। মহানবী (সা.)-এর অনেক শত্রুই আন্তরিক বন্ধু হয়েছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে হারিস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) মৃদু হাসি ছাড়া কখনো উচ্চস্বরে হাসেননি। তাই আমাদের উচিত আমাদের সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করা।

শিষ্টাচার অর্জনের উপায়

মানুষের অন্তরে এমন আদব জন্মায় না। এটা উপার্জন করতে হবে। সেজন্য শিষ্টাচারের চর্চা শৈশব থেকেই শুরু করা উচিত। শৈশবে ভদ্রতা শেখা হলে, ভবিষ্যতের শিশু একটি মার্জিত প্রকৃতির হবে। তাই কোন পরিবেশে, কার সাহচর্যে, শিশু কীভাবে বেড়ে উঠছে তা গুরুত্বপূর্ণ। একটি শিশু তার পরিবার থেকে শিষ্টাচার শেখে। তাই সন্তানের চরিত্র গঠনে অভিভাবকদের নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগ দিতে হবে।

পরিবেশ

শিশুকে শৃঙ্খলা অর্জনের জন্য একটি সুন্দর পরিবেশ দিতে হবে। কারণ পরিবেশের প্রভাব শিশুর চরিত্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পরিবার
একটি শিশুর সবচেয়ে কাছের বন্ধুরা তার পরিবারের সদস্য। শিশুরা অনুকরণ করতে ভালোবাসে। তাই শিশুর আদব-কায়দা শেখার জন্য পরিবারের সদস্যদের ভালো চরিত্রের অধিকারী হতে হবে।

সহপাঠী

ছাত্রজীবন শিষ্টাচার অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। একজন শিক্ষার্থী স্কুল-কলেজের সহপাঠীদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখে। তাই অভিভাবকদের নিশ্চিত করতে হবে শিক্ষার্থী কীভাবে সহপাঠীদের সাথে মিলিত হচ্ছে।

ধর্মীয় অনুশীলন

একটি শিশুর চরিত্র গঠনে ধর্মীয় অনুশীলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে।
সাংস্কৃতিক অনুশীলন: সাংস্কৃতিক অনুশীলন এবং সমমনা ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ শিষ্টাচার শেখার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পারে।

পড়ার বই

ভালো বইও শিষ্টাচার শেখাতে সাহায্য করে, যেমন একজন ভালো বাবা-মা করে।
আদব না থাকার অসুবিধা
শিষ্টাচারহীন সমাজ বিবেকহীন। শিষ্টাচারের অভাবে সমাজে মানুষের নৈতিক ও চারিত্রিক অবক্ষয় ঘটে যার ফলে হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি-মারামারি, অন্যায় নির্যাতন, ধর্ষণ, ইভটিজং ইত্যাদির জন্ম হয়। মানুষ পশুর চেয়ে বেশি হিংস্র হয়ে ওঠে। সেই হিংস্র লোকদের খপ্পরে পড়ে সমাজ হয়ে উঠেছে বর্বর। সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়, সমাজ প্রেমহীন হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, অর্থনীতিতেও এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

শিষ্টাচারের উপকারিতা

একটি ভদ্র সমাজ একটি স্বর্গীয় সমাজের মতো। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেনঃ যুক্তিযুক্ত কারণ থাকা সত্বেও ঝগড়া ত্যাগকারীর জন্য জান্নাতে একটি স্থান তৈরি করা হয়।
শিষ্টাচার এমনই হওয়া উচিত। অন্যের দোষ-ত্রুটি জেনেও তাদের প্রতি ভালো হওয়াটাই শিষ্টাচারের বৈশিষ্ট্য। একটি ভদ্র সমাজ মানুষের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখে। সমাজে অন্যায় ও অনাচার বিরাজ করে না। সাদা-কালো ভেদ নেই। সমাজ সুন্দর ও স্বর্গীয় হয়ে ওঠে। চারিত্রিক সৌন্দর্য মানুষের ভালোবাসা ও সম্মান জয় করতে পারে।

উপসংহার

মার্জিত, রুচিশীল ও সম্মানিত ব্যক্তি সমাজ ও জাতীয় জীবনে বিশেষ অবদান রাখতে পারেন। মানুষ তার উত্তম আচরণ ও চরিত্র দ্বারা পরিবারসহ সমাজকে আলোকিত করতে পারে। পক্ষান্তরে, ভয় এবং অশিক্ষিত এবং কুসংস্কৃতির আচার-আচরণ একে প্রতিনিয়ত মানবিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করতে এবং ব্যক্তির চরিত্রকে কলুষিত করতে বাধা দেয়। মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ে একটি জাতি দুর্বল ও দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে যে অশ্লীলতা, উচ্ছৃঙ্খলতা ও উচ্ছ্বাস প্রকাশ পাচ্ছে তা বিভক্তিমূলক পণ্য সংস্কৃতির বিস্তারের ফল। এটা জাতির মর্যাদার অভাবের লক্ষণ। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে ব্যক্তি, সামাজিক ও জাতীয় জীবনে সুস্বাস্থ্য ও সৌহার্দ্য কামনা করে সদাচারের অনুশীলন করতে হবে। কারণ শিষ্টাচারই একজন ব্যক্তির প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার ভিত্তি।

আরও দেখুন

পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার
পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার
প্রবন্ধ রচনাসমূহ
শিষ্টাচার
শিষ্টাচার
প্রবন্ধ রচনাসমূহ
পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার
পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার
প্রবন্ধ রচনাসমূহ