বাংলাদেশের পোশাক শিল্প

প্রবন্ধ রচনাসমূহ

  • ১ মাস আগে
  • |
  • ১৬৮ জন দেখেছেন

ভূমিকা

আধুনিক বিশ্বে শিল্পায়নের ধারণা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষের পরিধেয় কাপড়ের উৎপাদন এক সময় শিল্প হিসেবেও পরিচিত ছিল। আজ অনেক দেশে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে পোশাক শিল্প নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এই সম্ভাবনার সংযোজন আমাদের বাংলাদেশেও ঘটেছে। বাংলাদেশ বর্তমানে বিদেশে পোশাক রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। প্রকৃতপক্ষে, পোশাক শিল্প জাতীয় আয়ের প্রায় 64 শতাংশ জোগান দেয়। তাছাড়া এই শিল্প অনেক বেকারের কর্মসংস্থান করেছে। তাদের অধিকাংশই নারী। এর ফলে একদিকে যেমন নারীদের অর্থায়ন ও ক্ষমতায়নের কিছু সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, অন্যদিকে পুরুষের লাঞ্ছনার হাত থেকেও রক্ষা পাচ্ছে। পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তাদের দ্বারা শোষিত হলেও সামগ্রিকভাবে এই শিল্প আমাদের দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে।

বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের অতীত অবস্থা

সুদূর অতীত থেকেই বিশ্ববাজারে বাংলার পোশাক শিল্পের যথেষ্ট চাহিদা ছিল। বিশেষ করে মসলিন ও জামদানি নামক সূক্ষ্ম কাপড় ছিল বিশ্ব বিখ্যাত। কিন্তু ব্রিটিশদের আগমনে পোশাক শিল্প অনেকাংশে ধ্বংস হয়ে যায়। তারা তাঁতশিল্পকে ধ্বংস করার জন্য নানা পরিকল্পনা করে। কাপড়ের বাজার তৈরির জন্য তারা মেশিনের মাধ্যমে বস্ত্র তৈরি শুরু করে। ফলে এক পর্যায়ে পোশাক শিল্প তার নিজস্ব স্বকীয়তা হারাতে থাকে।

বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বর্তমান অবস্থা

দীর্ঘ যাত্রার পর বাংলাদেশ তার তৈরি পোশাক শিল্পের মাধ্যমে বস্ত্র খাতে তার হারানো গৌরব ফিরে পেতে চাইছে। এই শিল্প দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি উৎসাহব্যঞ্জক অবদান রেখে চলেছে। তবে বস্ত্র খাতের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ কিছু শিল্প পণ্য বিদেশে রপ্তানি শুরু করে। 1977 সালে, বেসরকারী শিল্প উদ্যোক্তাদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের বিকাশ ঘটে। তখন মাত্র কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল।

1985 সালে তৈরি পোশাক শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। শুরুতে ১৫০টি পোশাক কারখানা ছিল। এই সীমিত সংখ্যক কারখানা দিয়ে পোশাক শিল্পের সূচনা হলেও শিল্পপতিরা ধীরে ধীরে কারখানার সংখ্যা ও শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ান। দেশীয় উদ্যোক্তাদের সক্রিয় ভূমিকার কারণে এসব শিল্পের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন হাজারের বেশি। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় ১৮ লাখ লোক কর্মসংস্থান করেছে, যার মধ্যে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেশি, প্রায় ৮৫%।

পোশাক শিল্পের ইতিহাস

জীবনধারণের জন্য যেমন খাদ্যের প্রয়োজন, তেমনি সমাজে বসবাসের জন্য মানুষের বস্ত্রের প্রয়োজন। প্রাচীনকালে, লোকেরা লতা, পাতা, বাকল এবং পশুর চামড়া দিয়ে তাদের বস্ত্রের চাহিদা মেটাত এবং পরবর্তীতে ধীরে ধীরে তন্তু, সুতা এবং কাপড়ের প্রচলন হয়। কবে, কবে এবং কোথায় প্রথম কাপড়ের ব্যবহার শুরু হয়েছিল তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও এক সময় মানুষ সুই সুতো দিয়ে সেলাই করে নিজেদের কাপড় তৈরি করত। ধীরে ধীরে মানুষ সেলাই মেশিনের সাহায্যে কাপড় তৈরি করতে থাকে। সেলাই মেশিনের সাহায্যে মানুষের কাপড় সেলাইয়ের ইতিহাস মাত্র 260 বছর আগের গল্প। সেলাই মেশিন উদ্ভাবকদের প্রাচীন ইতিহাস থেকে দেখা যায় যে ইংল্যান্ডের চার্লস ফ্রেডরিক 1755 সালে প্রথম যান্ত্রিক সেলাই মেশিন আবিষ্কার করেন। তারপর সেলাই মেশিন হাতের সেলাইয়ের মতো সেলাই তৈরি করতে পারে। আইজ্যাক মেরিট সিঙ্গার 1851 সালে বাণিজ্যিকভাবে সফল সেলাই মেশিন আবিষ্কার করেছিলেন।

বাংলাদেশের পোশাক শিল্প এবং এর ভবিষ্যৎ

বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু হয় ষাটের দশকে। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানিমুখী শিল্প। 1960 সালে, বাংলাদেশের প্রথম পোশাক ঢাকার উর্দু রোডে রিয়াজ স্টোর নামে যাত্রা শুরু করে। 1967 সালে, রিয়াজ স্টোরের উৎপাদিত 10,000 পিস শার্ট প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ থেকে দেশের বাইরে (যুক্তরাজ্য) রপ্তানি করা হয়েছিল। এরপর 1973 সালে তিনি রিয়াজ স্টোর" এর নাম পরিবর্তন করে "রিয়াজ গার্মেন্টস" করেন। এছাড়া এ যুগের আরও একটি পোশাকের কথা শোনা যায়, তা হলো ‘দেশ গার্মেন্টস’। দেশ গার্মেন্টস তখনকার 100% রপ্তানিমুখী পোশাক ছিল। ৭০ এর দশকের শেষের দিকে এদেশে মাত্র ৯টি রপ্তানিমুখী কোম্পানি ছিল যারা ইউরোপের বাজারে প্রতি বছর ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসা করত। সে সময় দেশে বড় ও বিখ্যাত পোশাক কারখানা ছিল ৩টি। সেগুলো হলো- রিয়াজ গার্মেন্টস, প্যারিস গার্মেন্টস, জুয়েল গার্মেন্টস।

পোশাক শিল্পের বাজার

যেকোনো উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পণ্যের বাজার তৈরি করা। তা না হলে পণ্য যতই ভালো হোক না কেন তা কোনো কাজে আসে না। আশার কথা, বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বিশ্ববাজারে যথেষ্ট চাহিদা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের তৈরি পোশাকের প্রধান বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। কানাডা, ইইসি দেশ, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ছাড়াও ২৩টি দেশে বাংলাদেশ তার পোশাক রপ্তানি করে। এসব পোশাকের মধ্যে রয়েছে শার্ট, পায়জামা, জিন্স প্যান্ট, জ্যাকেট, ল্যাবরেটরি কোট, গেঞ্জি, সোয়েটার, পুল ওভার, খেলাধুলার পোশাক, নাইট ড্রেস ইত্যাদি। বর্তমানে বাংলাদেশের পোশাকের বাজার বিভিন্ন দেশে বিস্তৃত হচ্ছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পোশাক শিল্পের অবদান

পোশাক শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী অবদান রেখে চলেছে। এই সেক্টরের অবদানের প্রধান দিকগুলি নিম্নরূপ:

অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং রপ্তানি বৃদ্ধি

পোশাক শিল্পের বিকাশের সাথে সাথে দেশের রপ্তানি পণ্যের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের দেশের প্রায় শতাধিক বায়িং হাউস পোশাক ক্রয়-বিক্রয়ের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। জাতীয় আয়ের প্রায় ৬৪% আসে এই খাত থেকে। তবে এই আয় নির্ভর করে রপ্তানি বাণিজ্যের ওপর।

বেকার সমস্যা সমাধান

এই শিল্প বেকারত্ব হ্রাস এবং জাতীয় জীবনে স্বনির্ভরতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে কারণ এই খাতে দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের এক মিলিয়নেরও বেশি নারী শ্রমিককে কর্মসংস্থান করা যেতে পারে।

দ্রুত শিল্পায়ন

পোশাক শিল্প দ্রুত শিল্পায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ফলে এদেশে বিভিন্ন স্পিনিং, উইভিং, নিটিং, ডাইং, ফিনিশিং, প্রিন্টিং ইত্যাদি শিল্প গড়ে উঠছে। এ ছাড়া গার্মেন্টস, জিপার, বাটাম, ব্যাগলা ইত্যাদি শিল্পের প্রসার ঘটছে।

পরিবহন এবং পোর্ট ব্যবহার

পোশাক শিল্পের আমদানি-রপ্তানি বন্দর থেকে কারখানায় পরিবহন শিল্পের অগ্রগতি এবং এগুলোর যথাযথ ব্যবহারে নেতৃত্ব দিয়েছে।

অন্যান্য অবদান

পোশাক শিল্পে বিনিয়োগ করে ব্যাংকগুলো লাভবান হচ্ছে। বীমা কোম্পানির প্রিমিয়ামের পরিমাণ বাড়ছে। বাংলাদেশে আসছে নতুন নতুন প্রযুক্তি।

ফ্যাশন শিল্পে সমস্যা

1 জানুয়ারী, 2005 থেকে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) দ্বারা প্রবর্তিত টেক্সটাইল এবং পোশাক সংক্রান্ত চুক্তি কার্যকর হয়। মাল্টিফাইবার অ্যারেঞ্জমেন্ট (MFA) চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। ফলে পোশাক শিল্প কোটা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। আসলে কোটামুক্ত বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার জন্য আমাদের দেশ এখনো প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি তৈরি করতে পারেনি। যেখানে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, চীন, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ কম খরচে মানসম্মত পোশাক উৎপাদন করছে, সেখানে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে। এই পশ্চাৎপদতার মূলে রয়েছে নানা সমস্যা।

 

পোশাক শিল্পের সম্ভাবনা

বাংলাদেশের বস্ত্র শিল্পের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। তবে আজকের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে টিকে থাকতে অনেক দূর যেতে হবে। এর জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। শিল্প প্রতিষ্ঠানের ISO সার্টিফিকেশন গ্রহণ করা উচিত। ক্রেতারা যেহেতু বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। সর্বোপরি, আমাদের টেক্সটাইল ও পোশাকের মান উন্নয়ন, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে দাম কমিয়ে চ্যালেঞ্জকে সুযোগ হিসেবে নিতে হবে। সে লক্ষ্যে সরকার, উদ্যোক্তা ও ব্যাংকগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।

বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের অবস্থান

2021 সালের শেষে, পোশাক রপ্তানিতে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের তুলনায় বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে 4.72 বিলিয়ন ডলার। এর ফলে পোশাক রপ্তানিতে ভিয়েতনামকে টপকে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ২০২১ সালে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারে ৩ হাজার ৫৮০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। একই সঙ্গে পোশাক শিল্পের বিশ্ব বাণিজ্যে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের রপ্তানি মূল্য ছিল ৩ হাজার। 108 মিলিয়ন ডলার। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে চীনের অবস্থান প্রথম। আর বাংলাদেশ থেকে এক ধাপ নিচে অর্থাৎ প্রধান প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম চলে গেছে তৃতীয় স্থানে।


উপসংহার

মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং দেশের বেকারত্ব সমস্যা সমাধানে পোশাক শিল্পের ভূমিকা অনন্য। 1977 সালে হাতে গোনা কয়েকটি কারখানা নিয়ে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সূচনা হয়েছিল, আজ এর সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে। জাতীয় আয়ের পাঁচ শতাংশের বেশি আসছে এ শিল্প থেকে। তাই এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, সব ক্ষেত্রে সরকারি অনুগ্রহ পেলে এই শিল্প আরও সমৃদ্ধ হবে এবং বাংলাদেশের জন্য অসীম সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে। আর পোশাক শিল্প ভবিষ্যতে আরও আধুনিক হয়ে উঠবে।

 

 

 

 

 

আরও দেখুন

পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার
পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার
প্রবন্ধ রচনাসমূহ
পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার
পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার
প্রবন্ধ রচনাসমূহ
শিষ্টাচার
শিষ্টাচার
প্রবন্ধ রচনাসমূহ